সুরা বাকারার ২১-২২ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাজিল করেছেন বৃষ্টি। তারপর তার মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল-ফলাদি, তোমাদের জন্য রিজিক হিসেবে। সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না।’
এ দুটি আয়াতের মর্ম ও বিধান
মানুষকে একনিষ্ঠভাবে তার ইবাদত করার নির্দেশ দেওয়ার পরপরই আল্লাহ তাআলা মানুষের ওপর তার নেয়ামতের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ করেছেন জমিনে মানুষ ও পশুর খাবার হিসেবে তিনি বিভিন্ন রকম ফল ফসল সৃষ্টি করেন। কোরআনের আরেক জায়গায় আল্লাহ বর্ণনা করেছেন, আমিই প্রচুর বারি বর্ষণ করি, অতঃপর আমি ভূমিকে প্রকৃষ্ট রূপে বিদীর্ণ করি; এবং ওতে আমি উৎপন্ন করি শস্য; আঙ্গুর ও শাক-সবজি, জয়তুন, খেজুর, ঘন বৃক্ষ পরিপূর্ণ বাগবাগিচা, নানান জাতের ফল আর ঘাস-লতাপাতা। এগুলো তোমাদের ও তোমাদের পশুগুলোর ভোগের জন্য। (সুরা আবাস: ২৫-৩২)
আল্লাহ নিজেকে মানুষের রিজিকদাতা উল্লেখ করে অন্য কাউকে তার সমকক্ষ নির্ধারত করতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ মানুষকে আল্লাহ অমুখাপেক্ষী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ নিজের খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা নিজে করতে সক্ষম। তাই লোভে পড়ে মানুষের মুখাপেক্ষী হওয়া সমীচীন নয়। যে একেবারে অপরাগতা ছাড়া শুধু লোভে পড়ে অন্যের দয়া ভিক্ষা করে, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়, সে আল্লাহর নেয়ামতের অবমূল্যায়ন করলো। আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করার মতো একটা কাজ করলো।
ইসলামে ইবাদত জায়েজ শুধু এক আল্লাহর যিনি মানুষ ও বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও রিজিকদাতা। ইবাদতের অন্যতম অনুসঙ্গ তাকওয়া বা খোদাভীরুতা। আল্লাহর শরিয়তের বাইরে যাওয়া, তার নির্দেশ পালন না করা বা নিষেধ লঙ্ঘন করার সাহস একজন মুমিনের হওয়ার কথা নয় যে যথাযথভাবে আল্লাহর ওপর ইমান এনেছে।
আল্লাহ জমিনকে বিছানা বানিয়েছেন মানে জমিনকে মানুষের বসবাসের উপযোগী সমতল ও স্থীর বানিয়েছেন। কেউ যদি আল্লাহর নামে শপথ করে বলে যে সে বিছানায় ঘুমাবে না, তাহলে এ আয়াতের কারণে জমিনে ঘুমালে তার শপথ ভাঙবে না। এটা ইমাম আবু হানাফি ও শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারী আলেমদের মত। কারণ বিছানা বলে মানুষ জমিন বোঝায় না। মানুষের সাধারণ ব্যবহার অনুযায়ী শপথের অর্থ ধর্তব্য হয়। মালেকি মাজহাবের অনুসারী আলেমদের মতে শপথের অর্থ ধর্তব্য হয় নিয়ত অনুযায়ী অথবা প্রসঙ্গ বা কারণ অনুযায়ী, এগুলো না পাওয়া গেলে মানুষের ব্যবহার অনুযায়ী, তাও না পাওয়া গেলে আভিধানিক অর্থ অনুযায়ী।
এ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় আল্লাহ এক ও একক। তিনি অতুলনীয় স্রষ্টা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী। আমাদের চারপাশের জগত, খুটিহীন আকাশ, পৃথিবী তার অসীম ক্ষমতার প্রমাণ বহন করছে। অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, আর আমি আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ; কিন্তু তারা তার নিদর্শনাবলী হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়। (সুরা আম্বিয়া: ৩২)
আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না।’ এখানে মানুষকে তার জ্ঞান ও বুদ্ধি কাজে লাগাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্ধ অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। মুশরিকরা জানতো আল্লাহই তাদের স্রষ্টা ও রিজিকদাতা, তাদের বানানো শরিকরা না। যে কেউ নিজের জ্ঞান ও আকল কাজে লাগালে এটা বুঝতে পারবে।
আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে কোনো মাধ্যমেরও প্রয়োজন নেই। আল্লাহ বলেন, জেনে রেখ, শুধু আল্লাহর জন্যই বিশুদ্ধ ইবাদত-আনুগত্য। যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ইবাদত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে।’ যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে আল্লাহ নিশ্চয় সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না। (সুরা জুমার: ৩)
উৎস: আত–তাফসিরুল মুনির