সোনা চোরাচালানকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান। অর্থবিত্ত আর অবৈধ সম্পদের সিঁড়ি বানিয়ে হয়ে ওঠেন অপরাধজগতের বেপরোয়া মাফিয়া
মানবিকতার ফেরিওয়ালা সেজে মুখোশের আড়ালে সোনা চোরাচালানের অপ্রতিরোধ্য নায়ক হয়ে ওঠা দিলীপ আগরওয়ালার উত্থান সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। চুয়াডাঙ্গার সীমান্তবর্তী গ্রাম থেকে উঠে আসা সাধারণ দিলীপ আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতা, নারী আর সোনা চোরাচালানকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান। আর এটিকেই নিজের অর্থবিত্ত আর অবৈধ সম্পদের সিঁড়ি বানিয়ে হয়ে ওঠেন অপরাধজগতের বেপরোয়া মাফিয়া। নিজেকে বড় আওয়ামী লীগার পরিচয়ে সভা-সমাবেশে, বক্তব্যে অনিয়ম-দুর্নীতি, মাদক ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে সততার বন্দনা করেছেন অবিরাম।
অথচ আড়ালে ছিলেন অন্ধকারজগতের কারিগর। গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের নাম ভাঙিয়ে গত দেড় দশকে গ্রামের সাধারণ দিলীপই হয়ে ওঠেন হাজার কোটি টাকার মালিক।
সরেজমিন চুয়াডাঙ্গা ঘুরে ও তাঁর এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্যই পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, দিলীপ আগরওয়ালার মুখোশের আড়ালের ছবিটি সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানতেন না।
সবার চোখে ধুলা দিয়ে চোরাকারবারির কালো অধ্যায় গড়ে তুলেছেন র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আওয়ামী লীগ নেতা দীলিপ কুমার আগরওয়ালা। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বন্ধু ওয়াজ কুরুনি টিটুর সঙ্গে চুয়াডাঙ্গায় ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন দিলীপ। ঠিকাদারি ব্যবসায় সুবিধা করতে না পারলেও নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে জনরোষের শিকার হয়ে পালিয়ে যান ঢাকায়। সেখানে গিয়ে তাঁর কাকা পবন আগরওয়ালার সঙ্গে সিনেমার কাজ শুরু করেন।
সেই সুবাদে তখনকার উঠতি বয়সী মডেল-নায়িকাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন দিলীপ। সিনেমা ব্যবসার পাশাপাশি রাজধানীতে সোনার দোকান ছিল পবনের। সেই ব্যবসার কেয়ারটেকারের দায়িত্ব পান দিলীপ।
চতুর দিলীপ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিশেই সোনা ব্যবসার গোমর জেনে যান। কৌশলে বাড়তি অর্থ আয়ের পথ খুঁজে বের করেন তিনি।
সীমান্তবর্তী এলাকায় জন্ম নেওয়া দিলীপের চোরকারবারিদের সঙ্গে কৈশোর থেকেই চেনাজানা ছিল। ফলে সহজেই সীমান্তবর্তী চৌগাছা, মহেশপুর ও জীবননগরের বিভিন্ন পয়েন্টের কারবারিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। প্রথম দিকে ব্যবসায় সুবিধা করতে পারছিলেন না দিলীপ। এরপর কৌশল হিসেবে উঠতি বয়সীদের নিয়ে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। যারা বিনিয়োগের জন্য অর্থের সংস্থান করে। সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ধীরে ধীরে ব্যবসার সম্প্রসারণ করেন তিনি।
সূত্র বলছে, ব্যবসার শুরুতে পবনের দোকান থেকে দুবাই, সিঙ্গাপুর থেকে পাচার হওয়া সোনা সংগ্রহ করতেন ব্যবসায়ীরা। ধীরে ধীরে এই ব্যবসা প্রসার হতে থাকে। ২০০৫ সালের দিকে কৌশলে পবনের প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়ে গড়ে তোলেন ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন আমলা-মন্ত্রীদের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। এমনকি তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্য উঠতি বয়সী মডেল ও নায়িকাদের ব্যবহার করতে থাকেন। এরপর দিলীপকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় নিজ জেলা চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরা সীমান্তে গড়ে তোলেন শক্ত সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার, যশোরের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক সংসদ সদস্য শাহিন চাকলাদার, ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুল করিম মিন্টু, কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলমসহ কয়েক উপজেলার অন্তত ২৫ জন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি ছিলেন বলে অনুসন্ধানে উঠে আসে। এক পর্যায়ে দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশ থেকে অবৈধ পন্থায় সোনা এনে ভারতে পাচার করতে থাকেন। এভাবেই কয়েক বছরের ব্যবধানে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান দিলীপ কুমার আগরওয়ালা।