মুন্সীগঞ্জের কৃষকদের মধ্যে বিষমুক্ত সবজি চাষের প্রবণতা বেড়েছে। বিষমুক্ত সবজির চাহিদা বৃদ্ধি ও ভালো দাম পাওয়ায় এ পদ্ধতিতে সবজি চাষে ঝুঁকছে কৃষক।
শীতকালীন শাকসবজি উৎপাদনের অন্যতম ভূমি হিসেবে পরিচিত মুন্সীগঞ্জের রামপাল ও বজ্রযোগিনী ইউনিয়ন। চলতি মৌসুমে দুই ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের মাঠে বিষমুক্ত শাকসবজি চাষের ধুম পড়েছে। প্রচুর পরিমাণ আবাদ করেছেন কৃষকরা। কোনো কোনো গ্রামের কৃষক আগেভাগেই আবাদ করেছিলেন। ইতোমধ্যে মুলা, শিম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, লাউ, গাজর ও শাক বিক্রিও করেছেন তারা। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার এসব সবজির দাম বেশি। মৌসুমের শুরু থেকে ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।
গত বছর বাঁধাকপি-ফুলকপির পিস ১৫-২০ টাকা বিক্রি করলেও এবার ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি করছেন উল্লেখ করে এই কৃষক বলেন, মৌসুমের শুরুতে মুলা, শিম, গাজর, লালশাক, পালংশাক ও বেগুনের দাম ভালোই পেয়েছেন। এখন কিছুটা দাম কমে গেছে। তবু তারা সন্তুষ্ট। তাদের এলাকার প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। আগের তুলনায় এখন আবাদ অনেক বেড়েছে। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষক।
শত বছর ধরে এই অঞ্চলের কৃষকরা শাকসবজি আবাদ করছেন বলে জানালেন সুখবাসপুর গ্রামের কৃষক রুহুল আমিন। তিনি বলেন, একসময় এখানে কলার পাশাপাশি সবজি চাষ হতো। এখন কলার আবাদ বন্ধ হয়ে গেলেও শাকসবজির চাষ ধরে রেখেছেন তারা। এতে বেশ লাভবান হচ্ছে সবাই।
নাহাপাড়া গ্রামের কৃষক আলাউদ্দিন বেপারি বলেন, অন্যান্য অঞ্চলের বাঁধাকপি-ফুলকপির পিস যদি ২০ টাকায় বিক্রি হয় তাহলে তাদেরগুলো ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি করেন। এর কারণ সবজি বিষমুক্ত। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার সব ধরনের সবজির ফলন ভালো হয়েছে, দামও বেশি পেয়েছেন। শিমের কেজি ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। এতে তারা অনেক খুশি। আরও দুই মাস শাকসবজি বিক্রি করতে পারবেন। এরপর জালি কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, শশা ও করলা আবাদ করবেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এ বি এম ওয়াহিদুর রহমান বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় চার হাজার ৫৯৯ হেক্টর জমিতে শীতকালীন শাকসবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ৩ হাজার ২০০ হেক্টর। বাকি জমিগুলোতে আগামী দিনে চাষাবাদ হবে। আশা করছেন, লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। এর কারণ এবার শাকসবজির দাম ভালো পেয়েছেন কৃষক।
জেলার মধ্যে রামপাল ও বজ্রযোগিনীতে শাকসবজি বেশি আবাদ হয় উল্লেখ করে ওয়াহিদুর রহমান বলেন, শুধু মুন্সীগঞ্জে নয়, অন্যান্য জেলাতেও এসব শাকসবজির কদর রয়েছে। কারণ এখানকার কৃষকরা প্রাকৃতিক জৈব সার ব্যবহার করেন। রাসায়নিক সার দেন না। দাম ভালো পাওয়ায় দিন দিন বিষমুক্ত সবজির আবাদ বাড়ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, দিন দিন রামপাল ও বজ্রযোগিনীর বিষমুক্ত শাকসবজির চাহিদা বাড়ছে। এ কারণে আবাদও বেড়েছে। দাম ভালো পাওয়ায় চাষাবাদে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকদের।
সম্প্রতি সদর উপজেলার রামপালের সুখবাসপুর, রামশিং, ধলাগাঁও, রামেরগাঁও, চুড়াইন এবং বজ্রযোগিনীর আজিমপুরা, কল্যাণশিং, সুয়াপাড়া ও নাহাপাড়াসহ ২০ গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, উঁচু জমিতে শাকসবজি আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুলা, শিম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, লালশাক, পালংশাক, বেগুন, কাঁচামরিচ ও ধনেপাতা। প্রতিদিন সকাল-বিকেল মাঠের শাকসবজি তুলে বিক্রি করছেন কৃষকরা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রামপাল ও বজ্রযোগিনীর শাকসবজি আবাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য শত বছরের। শুরুতে এখানে উৎপাদিত শাকসবজি স্থানীয়দের চাহিদা পূরণ করলেও ধীরে ধীরে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ছাড়াই শাকসবজি উৎপাদন হওয়ায় গুণে ও মানে অনন্য এবং খেতে সুস্বাদু। ফলে প্রতিদিন এখানকার শাকসবজি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।
সুখবাসপুর গ্রামের কৃষক নুরে আলম বলেন, রামপালের অন্তত ১০-১২টি গ্রামে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি আবাদ হয়। বিষমুক্ত এসব শাকসবজির চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। এখানকার মাটি উর্বর হওয়ায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিতে হয় না। এ এলাকার সবজির সুনাম ছড়িয়ে পড়ার এটিই মূল কারণ। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি জৈব সার জমিতে দেন তারা। এজন্য শাকসবজি খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি দামও কিছুটা বেশি।
আজিমপুরা গ্রামের কৃষক আব্দুস সালাম বলেন, বজ্রযোগিনীর অন্তত ১০টি গ্রামে শীতকালীন শাকসবজি উৎপাদন হয়। এখানের শাকসবজি বিষমুক্ত। তরতাজা খেতে পারছেন মানুষজন। সকালে জমি থেকে তুলছেন, সকালেই নারায়ণগঞ্জ-ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আবার বিকেলে তুলে বিকেলেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। চাহিদা বেশি থাকায় দামও একটু বেশি।